– আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ
ছোট ভাই’র জানাযায় হাজার মানুষের ভীড়ের মধ্যে নাজির ভাইয়ের সাথে সর্বশেষ দেখা। আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। মন খুলে দু’টি কথা বলার মত পরিবেশে ছিলাম না। এ দুনিয়ায় আর দেখা হবে না। ঐ দেখাই শেষ দেখা। তিনি চলে গেলেন। আর ফিরবেন না। তখন বুঝতে পারিনি এখানেই মানুষের চরম সীমাবদ্ধতা।
নাজির ভাই বলতেন “তোমরা আমাকে দিয়ে বেশী আশা করো না। আমি খুবই ভীরু মানুষ।” না, নাজির ভাই, আপনি ভীরু নন। ভীরু ছিলেন না। জরুরি অবস্থায় (২০০৭-০৮) নিজামী ভাই জেলে থাকা অবস্থায় দিন-রাত, সকাল-বিকাল-দুপুরে ডাকা জরুরি বৈঠকগুলোতে আপনি আগে এসে বসে থাকতেন। কখনও আপত্তি করেননি। বিরক্ত হননি বরং সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
সবাই যখন জেলে তখন আপনিও কারারুদ্ধ হয়েছিলেন। আপনাকেও রিমান্ডে নেয়া হয়েছিল। ডিবি অফিসে এবং ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ৯০ সেলে আপনাকে রাখা হয়েছিল। শুনেছি, আপনি সেখানেও দৃঢ় ছিলেন। অবিচল ছিলেন। আপনি ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দী ছিলেন না। কিন্তু এতে আপনি অসন্তুষ্ট ছিলেন না। আপনি নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত বা চিন্তিত ছিলেন না। আপনি চিন্তিত ছিলেন দেশ ও জনগণকে নিয়ে। ইসলামী আন্দোলনকে নিয়ে। চিন্তিত ছিলেন কারাবন্দী নেতা কর্মীদের নিয়ে। ময়দানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সংগ্রামরত জনগণ ও সাথীদের নিয়ে। আপনার চারিত্রিক মাধুর্য ত্যাগ, দেশপ্রেম অবিচল, ঈমান, পান্ডিত্য এবং অল্পেতুষ্ট মানসিকতা সংশ্লিষ্টদের মুগ্ধ করেছে, বিমোহিত করেছে।
কারাবন্দিত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে আপনার ভারসাম্যপূর্ণ বলিষ্ঠ নেতৃত্ব আমাদেরকে প্রেরণা জুুগিয়েছে। সাহস জুুগিয়েছে। জামায়াতের কেন্দ্রীয় ইফতার পার্টিতে, কূটনীতিকদের ইফতার পার্টিতে দেয়া আপনার বক্তব্যের ভাষা, প্রতিটি শব্দ ছিল বলিষ্ঠ, দরদপূর্ণ, প্রজ্ঞা ও পান্ডিত্যে ভরপুর। সংক্ষিপ্ত ও হৃদয় নিংড়ানো। চুম্বকের চেয়েও আকর্ষণীয়।
বড় বড় জন সমাবেশেও আপনাকে মঞ্চে দেখেছি। যে পরিবেশ ছিল আপনার জন্য নতুন ও অচেনা। মঞ্চে বসে ইসলামী আন্দোলনের নেতা-কর্মীদেরকে দেখেছেন, তাদের জীবন উৎসর্গ করার আকুতি অনুভব করেছেন, শুনেছেন বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত আল্লাহু আকবর ধ্বনি। দেখেছেন আবাল বৃদ্ধ, তরুণ, যুবক, ছাত্র জনতার লক্ষ শ্লোগান। অনুভব করেছেন, উপলব্ধি করেছেন তাদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ। জালেমের পৈশাচিক অত্যাচারের মোকাবিলায় জীবন উৎসর্গ করার দৃপ্ত শপথ। আর মঞ্চে দাঁড়িয়ে আপনার সংক্ষিপ্ত অর্থপূর্ণ বক্তব্য শ্রোতাদের করেছে অনুপ্রাণিত। শাহাদাতের জজবায় শত সহস্রগুণ উজ্জীবিত হয়েছে তারা।
সর্বশেষ, আপনি বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন জামায়াতের প্রতিনিধি হিসেবে। আপনি সেখানে বক্তব্য রেখেছিলেন সংক্ষিপ্ত তবে সঠিক ও প্রতিনিধিত্বমূলক। আপনার ঐ বক্তব্য উপস্থিত সকল শ্রোতাদের বিবেককে নাড়া দিয়েছিল।
অধ্যাপক এ, কে এম নাজির আহমেদ ছিলেন একজন অদম্য সাহসী নেতা। নির্ভেজাল এবং নি:স্বার্থ অভিভাবক। বিশ্বস্ত বড়ো ভাই, বন্ধু, সাথী।
নাজির ভাই ছিলেন সহজ সরল সাদা মাটা জীবনযাপনকারী একজন সফল নেতা। আল্লাহর গোলাম ও রাসূল (সাঃ) এর নিষ্ঠাবান অনুসারী। ‘শুনলাম ও মানলাম’ কুরআন হাদীস অনুসরণে এই ছিল তার নীতি। কখনও হারাম খাননি। কবীরা গুনাহ তাকে স্পর্শ করতে পারতো না। শিরকের গন্ধ পর্যন্ত তার জীবন প্রবাহে প্রবেশ করতে পারেনি। টাখনুর নিচে কাপড় পরিধান করতেন না। কখনও বাম হাতে খাননি। সৌন্দর্য পিপাসু ছিলেন। মানানসই কমদামী সাদামাটা জামা কাপড় পরতেন। চমৎকার পরিচ্ছন্ন ছিলেন। রুচিশীল তবে খুবই সাধারণ খাবার খেতেন। যা খেতেন তৃপ্তির সাথে খেতেন। অল্পে তুষ্ট ছিলেন। পরিতৃপ্তির সাথে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতেন।
আমরা যারা ইসলামী আন্দোলন করার সুযোগ আল্লাহর রহমতে পেয়েছি তাদের গড়ে উঠার ব্যাপারে নাজির ভাইয়ের অবদান অপরিসীম। তিনি আমাদের প্রাণভরে স্নেহ করতেন। তার স্নেহের গভীরতা ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। নিজামী ভাই থেকে শুরু করে আমরা সবাই তার ছাত্র। শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লাও তার অন্যতম প্রিয় ছাত্র। তার প্রিয়তম ছাত্র সত্যের জন্য, ইসলামের জন্য, দেশ ও জনগণের জন্য এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের তীব্র আকাঙ্ক্ষায় যেভাবে বীরের মত, নির্ভীক চিত্তে মাথা উঁচু করে ফাঁসির মঞ্চে গিয়েছেন তাতে নিশ্চয়ই আলোড়িত হয়েছেন নাজির ভাই।
অপর দিকে জালেমরা যেভাবে এক শতভাগ নিরপরাধ আব্দুল কাদের মোল্লাকে হত্যা করেছে তা তিনি অবশ্যই মেনে নিতে পারেন নি। ক্ষত বিক্ষত হয়েছে তার হৃদয়। হৃদয়ের এ রক্তক্ষরণ চোখে দেখা যায়নি। কিন্তু তিনি অনুভব করেছেন চরম বেদনা দিয়ে। আরও আঘাত পেয়েছেন লাশ দেখার সুযোগ না পাওয়ায়। জানাযা পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ায়।
অধ্যাপক এ কে এম নাজির আহমদ ইসলামী সাহিত্যের সমুদ্র সাদৃশ্য ভান্ডার গড়ে তুলেছেন। হাদীস গ্রন্থ বোখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, আবু দাউদ, নাসাই, রিয়াদুস সালিহীনসহ বিভিন্ন উৎস গ্রন্থ বিশুদ্ধ বাংলায় প্রকাশ করেছেন। অনুবাদ সাহিত্যকে করেছেন ধনী। কুরআন হাদীসের ভিত্তিতে রচিত ইসলামের মৌলিক সাহিত্য প্রকাশ করেছেন অর্ধশতাধিক। গড়ে তুলেছেন গবেষণা সেল। উচ্চ শিক্ষিত খ্যাতিমান গবেষকদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন সৃষ্টিশীল গবেষণাবলয়। ‘মাসিক পৃথিবী’ তার নিজস্ব সম্পাদনায় বাংলাদেশের সর্বাধিক প্রচারিত গবেষণা পত্রিকা। ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘কলম’ তার অবদানের স্বাক্ষর হয়ে আছে। বছরে তিন থেকে চারটা গবেষণা সংকলন প্রকাশ করতেন। আধুুনিক যুগ জিজ্ঞাসার আলোকে ইসলামের সঠিক জবাব ও সামাধান এতে সন্নিবেশিত হয়ে আসছে। নাজির ভাই আরও কয়েকটি ইসলামী গবেষণা প্রতিষ্ঠানে অবদান রেখে গেছেন। তিনি নিজের শতাধিক মৌলিক বই পুস্তিকা লিখেছেন ও প্রকাশ করেছেন।
ইসলামী সাহিত্যের মাধ্যমে ইসলাম, জনতা, মুসলিম উম্মাহ, ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের মাঝে অধ্যাপক এ কে এম নাজির আহমদ উজ্জ্বল তারকা হয়ে থাকবেন। সাদকায়ে জারিয়া হিসেবে সাওয়াব পেতে থাকবেন। পুরস্কার হিসেবে মহান আল্লাহ তার কবরকে জান্নাতের টুকরা হিসেবে সৌরভে ভরে দেবেন বলে আশা করি। আর এখানেই মানব জীবনের সাফল্য। এখানেই তার শেষ ঠিকানা- চিরন্তন ঠিকানা। মহান আল্লাহর সন্তুষ্টিই তার চরম ও পরম পাওয়া। দুনিয়াতে স্যালুট পেলেন কি পেলেন না তাতে কিছু যায় আসে না।
খুব সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন পারিবারিক জীবন ছিল নাজির ভাইয়ের। অল্পে তুষ্ট পরিবার। সবাই ইসলামী নীতিমালা বিধি-বিধান মেনে চলায় অভ্যস্ত। বিনয়ী ও বিনম্র পরিবারের সদস্যগণ। বলা যায় প্রতিবেশী বান্ধব ও সমাজ বান্ধব একটি সুখী পরিবার ছিল তার।
নাজির ভাইকে আর এ দুনিয়ায় দেখতে পাবোনা। নির্বাহী পরিষদ, কর্ম পরিষদ, মজলিসে শূরার বৈঠকে তাকে আর দেখা যাবে না। নায়েবে আমীর হিসেবে মঞ্চে আর পাওয়া যাবে না। দারসে কুরআনে, বক্তব্যে সেই অল্পভাষী কন্ঠ আর শোনা যাবে না।
শেষ দেখা দেখতে পাইনি। জানাযাও পড়তে পারিনি। সে বেদনা অব্যক্ত বেদনা। প্রাণ ভরে দোয়া আমাদের নেতার জন্য। আমাদের অভিভাবকের জন্য। চোখ দিয়ে অবিরাম পানি গড়িয়ে পড়ে। দাড়ি ভিজে যায়। নাক দিয়েও পানি ঝরে। জায়নামাজও ভিজে যায়। ভিজে জায়নামাজে হাত দিয়ে বারবার নাজির ভাইকে অনুভব করি।
আল্লাহ তাকে তুমি কবুল কর। আর আমাদেরকে এ জমীনে তোমার দ্বীনকে বিজয়ী করার শক্তি ও সুযোগ দাও। আমিন।